স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন যে এই প্রবণতা মহামারি ভাইরাসরোধে সরকারের প্রচেষ্টাকে নষ্ট করে দিতে পারে।
তারা আরও বলেন, যেসব রোগী তাদের লক্ষণ ও তথ্য গোপন করে চিকিৎসাসেবা নিতে আসছেন তাদের সংস্পর্শে আসায় অনেক চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী মারাত্মক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া নিয়ে তাদের যে ভয় তা দূরীকরণের পাশাপাশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করা হবে, তাদের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের মনোনিবেশ করা উচিত।
করোনাভাইরাস সম্পর্কে সাম্প্রতিক ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, কোভিড -১৯ এর লক্ষণ বহনকারী অনেক লোক তথ্য গোপন করছেন এবং পরীক্ষা করার ব্যাপারে খুব কম আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এটি একটি বড় সমস্যা।
‘এজন্য আমাদের অনেক চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছেন। গোপন করার এই প্রবণতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’
‘যদি লক্ষণ থাকে তবে পরীক্ষা করা উচিত। যথেষ্ট কিট রয়েছে এবং আরও অনেক আনা হচ্ছে। যখন পরীক্ষার সংখ্যা বাড়বে, করোনাভাইরাস রোগীদের শনাক্ত করা যাবে এবং এর বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে,’ তিনি বলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, সামাজিকভাবে হেয় এবং বিচ্ছিন্নতার ভয়ে অনেকের মধ্যে করোনার লক্ষণ ও চিকিৎসার ইতিহাস গোপন করার একটি বিপজ্জনক প্রবণতা গড়ে উঠেছে।
‘এই ব্যক্তিরা নিজের পাশাপাশি তাদের পরিবার, প্রতিবেশী এবং দেশকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। করোনার লক্ষণ দেখা দিলে মানুষকে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে এবং পরীক্ষা করানো উচিত,’ তিনি বলেন।
বিএসএমএমইউ ভিসি বলেন, কলঙ্ক না মনে করে প্রত্যেকেরই করোনাকে অন্যান্য রোগের মতো রোগ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। ‘যদি কেউ স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সামাজিক দূরত্বের নিয়মগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ না করে তবে তারা এতে সংক্রমিত হতে পারেন। তবে তাদের এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয় কারণ ৮০ শতাংশ মানুষ কেবল বিচ্ছিন্ন হয়ে এবং চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুসরণ করে হাসপাতালে না গিয়েই সুস্থ হতে পারেন।’
তিনি বলেন, অনেকেই মনে করেন যে করোনা পজেটিভ হলে তাদের তুলে নিয়ে আসোলেশন কেন্দ্রে রাখা হবে এবং তাদের বাড়ি লকডাউন করে দেয়া হবে। তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে নেতিবাচক আচরণ করা হবে এবং তাদের বর্জন করা হবে।
‘এজন্য তারা কোভিড -১৯ পরীক্ষায় আগ্রহী নন। এমনকি, তাদের মধ্যে কিছু চিকিৎসকের কাছে আসলেও তারা চিকিৎসার ইতিহাস এবং তাদের অবস্থান গোপন করেন। আমাদের এই সমস্যা সমাধান করা দরকার। তা না হলে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ এই ব্যক্তিদের করোনা শনাক্ত হবে না এবং তাদের পরিবারের সদস্য ও তাদের সংস্পর্শে আসা অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে থাকবে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, চিকিৎসার ইতিহাস এবং করোনাভাইরাসজনিত লক্ষণ গোপন করায় ওইসব রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে কিছু চিকিৎসক ও নার্স সংক্রমিত হয়েছেন।
‘শনিবার একজন রোগী তার করোনার লক্ষণ লুকিয়ে আমাদের হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে ভর্তি হন এবং ওয়ার্ডের চারজন নার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। রোগীরও করোনা ধরা পড়েছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একজন চিকিৎসকও তথ্য গোপন করা করোনা রোগীর চিকিৎসা দিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন,’ বলেন তিনি।
খান আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জ, মিরপুর ও নরসিংদীর মতো করোনাভাইরাস হটস্পট থেকে আগত অনেক রোগীও তাদের ঠিকানা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন। ‘তারা বলেন যে তারা বগুড়া বা অন্যান্য জেলা থেকে এসেছেন, যেখানে সংক্রমণ হার এখনও খুব কম।’
‘রবিবার আমাদের হাসপাতালের ৯২ জন রোগীর পরীক্ষা করা হয় এবং তাদের মধ্যে ৫২ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। যদিও এটি কোভিড -১৯ হাসপাতাল নয়। এটা খুব উদ্বেগজনক। এটি অব্যাহত থাকলে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। আমাদের চিকিৎসকরা ও নার্সরা যদি পরীক্ষা না করা রোগীদের সেবা দিয়ে সংক্রমিত হন তবে রোগীদের চিকিৎসা করবে কে? এটি একটি নতুন সংকট তৈরি করবে।’
তিনি বলেন, মানুষজনকে বুঝতে হবে যে তারা যদি ভুল তথ্য দিতে থাকেন তবে চিকিৎসকরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়বেন এবং তাদের প্রতি আস্থা হারাবেন। ‘রোগীদের সঠিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য চিকিৎসকদের সঠিক তথ্য এবং চিকিৎসার ইতিহাস জানতে হবে।’
তিনি গণমাধ্যমকে তাদের গোপন করার প্রবণতা পরিবর্তনে এবং পরীক্ষার জন্য উৎসাহ দিতে সচেতনতা তৈরি করার আহ্বান জানান।
আইইডিসিআর এর পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, তাদের একটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে যে অনেকেই তাদের লক্ষণ বা স্বাস্থ্যের ইতিহাস গোপন করছেন। ‘তাদের ভয় উপেক্ষা করে লক্ষণ এবং জটিলতা প্রকাশ করা উচিত।’
‘যত তাড়াতাড়ি আমরা সংক্রমিত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে সক্ষম হব এবং অন্যদের থেকে তাদের আলাদা করে ফেলব এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আমরা সক্ষব হব। সুতরাং, মানুষ যদি তাদের লক্ষণ আড়াল করে রাখে তবে আমরা তা শনাক্ত করতে সক্ষম হব না যা ভাইরাসটি মোকাবিলায় আমাদের প্রচেষ্টা আরও কঠিন করে দেবে,’ তিনি যোগ করেন।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে তাদের প্রতিদিনের ব্রিফিংয়ে পরীক্ষার জন্য মানুষজনকে এগিয়ে আসতে এবং করোনা শনাক্তকরণে মনোনিবেশ করতে তারা উৎসাহিত করার চেষ্টা করেন বলে জানান ফ্লোরা।
‘যাদের কোভিড -১৯ উপসর্গ রয়েছে তাদের হটলাইন নম্বরের মাধ্যমে অবিলম্বে আইইডিসিআরে যোগাযোগ করা উচিত বা পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে যাওয়া উচিত।’